Thumbnail image

তেল

“দাদা আমি এসে গেছি… আপনাদের আর কোনও চিন্তা নেই…”

ভিড় ট্রেনের কামরায় এরকম আশ্বাসবাণী স্বয়ং বিবেকানন্দ শোনাতে পারতেন কিনা জানি না, তবে এহেন বাণী লোকের মনে আশ্বাস না হোক কৌতূহল যে জাগ্রত করবেই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উৎসুক চোখে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে, একা নই, অনেকেই তাকালেন কামরার। পরনে একটা জিন্‌স আর আধময়লা ফতুয়া, কাঁধে ঝোলানো একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, যদিও সেটাকে ব্যাগ না বলে ঝোলা বলা ভালো। ফতুয়ার পকেট থেকে একটা কালচে শিশি বার করে আবার বলা শুরু করলেন।

“এই যে দাদা দেখছেন আমার হাতে, এ হল সাক্ষাৎ ভগবান, মহাবীর তেল…” এটুকু শুনেই বেশ কয়েকজন এমন ভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন যেন উনি দুনিয়ার সবথেকে বড় কসাই, আর আমরা হলাম নেহাতই মুরগি। যেন জবাই হওয়ার অপেক্ষাতে বসে রয়েছি। ভদ্রলোক বলে চললেন।

“এই যে মহাবীর তেল, এটি বাংলার ৪২টি গাছের নির্যাস দিয়ে তৈরি। বাংলার গাছ দাদা, কথা বলে। আর এর মত একজনকে বাড়িতে রাখা মানে একজন ডাক্তারকে বাড়িতে বসিয়ে রাখা। বাংলার ঘরে ঘরে এর দরকার। এর মত মহৌষধ দুনিয়ায় খুব কমই আছে। পড়ে গেছেন? ব্যথা? হাঁটুতে, কোমরে, ঘাড়ে, পিঠে যেকোনো ব্যাথার অব্যর্থ ওষুধ! আপনার বাড়ির দুরন্ত বাচ্চাটি খেলতে গিয়ে পা মচকেছে? কব্জি, গোড়ালি ফুলেছে? অল্প তেল নিয়ে মালিশ করুন, নিমেষে ব্যথা গায়েব। আপনার বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা কি ভুগছেন বাতের ব্যথায়? আরথ্রাইটিস, স্পঞ্জিলাইটিস? এই তেল নিয়ে গিয়ে মালিশ করে দিন, ব্যথা পালাতে পথ খুঁজে পাবে না। আপনার বাবা মা দু’হাত তুলে আপনাকে আশীর্বাদ করে যাবেন। মহাবীর তেল কোথাও করে না ফেল। এই বনগাঁ লোকালের কামরায় দাঁড়িয়ে আপনাদের বলছি, আমার যত বড় চ্যালেঞ্জ, তত বড় কাজ। মাথা ব্যথা? দুপুরবেলা অ্যাসিডিটির ট্যাবলেট খেয়েছেন বলে মাথা ধরে আছে? কপালে কয়েক ফোঁটা তেল ঢেলে মালিশ করে নিন। ধরা মাথা নিমেষে ছেড়ে যাবে। ঠান্ডা লেগেছে? বুকে কফ জমেছে। রাতে শোয়ার আগে অল্প তেল বুকে মালিশ করে নিন। মিছরির মত জমা কফ গলিয়ে বার করে দেবে। এ তেল বাড়ির তাকে তুলে রেখেদিন। ৫ বছর থাকে, নষ্ট হয় না। গুছিয়ে রাখুন, দরকারে ব্যবহার করুন। এ তেল সাক্ষাৎ ভগবান। এ তেল বাড়িতে রাখা মানে একজন গৃহডাক্তার রাখা। ছেঁড়া, কাটা পোড়া সব রোগের জন্য এ অব্যর্থ ওষুধ। দাঁতে যন্ত্রণা? ডাক্তার বলছে দাঁত তুলতে হবে? ভাববেন না। মহাবীর তেল নিমেষে আপনার যন্ত্রণার উপশম করবে। দাদ, হাজা, চুলকুনি সব রোগেই এই মহাবীর তেল সমান রকম কার্যকর। আয়ুর্বেদিক ওষুধ দাদা। বাংলার গাছ থেকে তৈরি। ভাবছেন কি?! আমার কাছে একটা ফাইল খোলা আছে। চাইলে পরখ করে দেখে নিন।”

এতক্ষণ কথা বলে ভদ্রলোক থামলেন। বোধ করি হাঁপিয়ে গেছেন। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলেন। তারপর ঘোষণা করলেন, “আমার কাছে তিন রকমের ফাইল আছে। ২০ টাকার ছোট স্যাম্পেল ফাইল, আর ৫০ টাকা ও ১০০ টাকার ফাইল… পরের স্টপেজে নামবো, কে কে নেবেন বলে ফেলুন” সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে। কিন্তু নেওয়ার সাহস বোধ হয় কেউ করে উঠতে পারছেন না। স্বাভাবিক, কারন আমি এই লাইনের রেগুলার যাত্রী না হলেও এটা পরিস্কার বুঝতে পারছি যে এই হকার ভদ্রলোককে এই লাইনেও কেউ দেখেননি আগে। আমি কি মনে করে বলে উঠলাম, “দাদা একটা ২০ টাকার ফাইল দিন।” উদ্দেশ্য ল্যাবে নিয়ে গিয়ে একবার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করিয়ে দেখা এতে সত্যিই আছে টা কি! ও হ্যাঁ, বলা হয়নি পেশাগত ভাবে আমি একজন ফার্মাসিস্ট। আমার দেখাদেখি একজন বলে উঠল, “দাদা ওষুধটা খুব কড়া না? আমারও একটা লাগবে ৫০ টাকার ফাইল।” একটা ২০ আর একটা ৫০ টাকার সাপোর্ট পেয়ে জনগনের প্রায় সবাই কোনও না কোনও ফাইল কিনতে লাগল। উফ্‌ সত্যি বলছি নিজেকে কিরকম মসীহার মত মনে হচ্ছিল। যেন এদের পথপ্রদর্শন করলাম! পরের ষ্টেশনে আমারও নামার কথা। সিট থেকে উঠে দু’পাশের সিটের মাঝের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে মোজেসের থেকে কোনও অংশে কম মনে হচ্ছিল না। এক সপ্তাহ পরের কথা। মহাবীর তেলের অমূল্য শিশিটার কথা মাথায় ছিল না। এরকম একজন স্বনামধন্য ডাক্তারকে এতদিন ব্যাগেই ফেলে রেখেছি ভাবতে নিজের মধ্যে কেমন একটা অপরাধ বোধ হচ্ছিল। তা হোক, শিশি থেকে খানিকটা তেল বার করে পাঁচটা ভায়ালে ভর্তি করে টেস্ট করার জন্য রেখে বাকি তেল সমেত শিশিটা মা’কে দিয়ে বললাম, “এই নাও ভগবান ইনি। সাক্ষাৎ মা গঙ্গা, তবে এতে দেবী স্বয়ং আছেন, গঙ্গাজল ভেবে ছিটিয়ে দিয়ো না যেন।”

ল্যাবে ঢুকে কাজ শেষ করে ভায়াল পাঁচটা বের করে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলাম। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এটাই যে, অনেক পরীক্ষা করেও জিনিসটা থেকে খুব কম মাত্রার মিথাইল স্যালিসাইলেট আর তার সোডিয়াম লবণ ছাড়া কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। সাধারনত বাম জাতীয় ওষুধে এটি ব্যবহার হয়ে থাকে এবং এটিই ঝাঁঝালো গন্ধের জন্য দায়ী। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, উত্তর আমেরিকার উইন্টারগ্রিন গাছের তেলের এই উপাদান কৃত্রিম প্রস্তুতি ছাড়াই কিভাবে বাংলার ৪২টি গাছের নির্যাসের উপাদানে নিজের অধিকার কায়েম করল! যদিও বাড়ি এসে দেখলাম, মা পরম যত্নে পূজার্চনা করছেন। সিংহাসনের একপাশে ঝকঝক করছেন সাক্ষাৎ ভগবান মহাবীর তেল।

পরদিন ল্যাবে যাওয়ার পথে বালিগঞ্জ চত্বরে একটা পরিচিত গলায় শুনতে পেলাম, “ভাই, মাথাটা ধরেছে, খুচরো আছে রে? দু’টো অ্যাসপিরিন কিনে আনি।” ঘাড় ঘোরাতেই গলার মালিককে চোখে পড়ল। অন্য এক হকারের সাথে কথা বলছেন, হাতে লজেন্সের প্যাকেট। এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, “দাদা লজেন্স খাবেন, ৩ টাকায় ৫ টা।” আমি গিয়ে বললাম, “না দাদা, মানে বলছিলাম কি আপনার তেল তো সত্যিই ভগবান! একেবারে নর্থ আমেরিকা থেকে সিধা আপনার শিশিতে আস্তানা গেড়েছেন। আমি রোজ পুজো করি। তা আপনি ওই তেলই একবার প্রনাম করে কপালে তুলে নিন না, ধরা মাথা এখুনি ছেড়ে যাবে।” তিনি হতভম্ব হয়ে যাওয়ায় আর আমার ল্যাবে দেরী হওয়ার ভয়ে ওঁর উত্তরটা আর জানা হয়ে ওঠেনি।

এরকম অন্যান্য লেখা