Thumbnail image

শুধু সুমনের জন্য

অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল সুমন। একঘেয়ে জীবন তার, ৯টা-৫টার অফিস তার নিত্য সঙ্গী। তার উপর থাকে ওভারটাইম। রবিবার ছুটি, কিন্তু বাড়ির কাজ তো আর কিছু কম থাকে না! বাবা গত হয়েছেন কিছুদিন হল। মা চলে গেছেন আরও আগে, তার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার আগেই। সেও প্রায় ৩ বছর হল। বি টেক কমপ্লিট করে ক্যাম্পাসিং এই ভালো আই টি কোম্পানী তে চাকরি পায় সুমন। বাবা খুশী হয়েছিলেন খুব। চিন্তিতও ছিলেন সুমনের বিয়ের কথা ভেবে। কিন্তু সে তো এসব বিয়ে টিয়ে ভাবেও নি।

বাবার কাজ সামলে ওঠার পর সুমন ভালোই বোঝে একাকীত্ব কী। মাঝে মাঝে মনে হয় একা সব সামলানো সম্ভব নয় বোধ হয়। বাবা ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন। ব্যবসা এখনও আছে। নিজেই সামলায় সুমন। কিন্তু আর হচ্ছে না এভাবে। কোনও দিন সুমন প্রেম করে নি। কাউকে ভালোলাগার ব্যাপার টাও তার জীবনে কখনও হয়নি। নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত ছিল সে এতদিন। এতো কথা ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল তার দেরি হয়ে গেছে। নিচে অফিস এর গাড়ি টা প্রায় ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি দরজা লক করে নিচে এসে গাড়িতে উঠলো সুমন। ড্রাইভার কে বলল, “ভাই লেট হয়ে গেল, সরি।” সামনে থেকে চিরপরিচিত গলায় উত্তর এল, “কোনও ব্যাপার নয় স্যার।”

অফিসে ঢুকতেই চোখ পড়লো সামনে বসে থাকা মধুজার ওপর। মধুজা অফিসে নতুন এসেছে। খুবই প্রাণবন্ত মেয়ে, কাজেও সুচারু। কদিন ধরেই খেয়াল করছে সুমন মধুজার হাবভাব যেন অন্য রকম হয়েছে একটু। কথা বললেই সুমনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কাজ শেষ হলে যাওয়ার আগে তার সাথে দেখা না করে মধুজা যায় না। আজ মধুজা তাকে দেখেই হেসে শুভ নববর্ষ জানালো। সুমনও শুভ নববর্ষ জানিয়ে চলে এল নিজের টেবিলে। এসে কাজে বসলেও মনে আসছে মধুজার কথা।

নিউ ইয়ার ডে তে তাড়াতাড়ি সবাই চলে যাচ্ছে। মধুজাও বেরিয়ে আসছিল। হঠাৎ মনে পড়লো তার সুমন বেরয় নি। সুমনের জন্য ওয়েট করা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। অদ্ভুত ছেলেটা। সারাদিন কাজ নিয়ে থাকে! মধুজার খুব পছন্দ হয়েছে ওকে। ভালোবাসা যে বড় বাজে জিনিস। কখন কার ঘাড়ে চাপবে কেউ জানে না। মধুজা তাকালো সুমনের টেবিলের দিকে। সুমন নেই সেখানে। ছেলেটা গেল কোথায়?! পেছন থেকে ডাক এল, “মধুজা, যাবে না?” সুমন কখন যে বেরিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে, মধুজা বুঝতেই পারে নি। অফিসের গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতে হঠাৎ মধুজা জিজ্ঞেস করলো, “সুমন, আজ বছরের প্রথম দিনে চল না কফিশপে যাই।” সুমন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতেই দুজনে গিয়ে হাজির হল অফিস লাগোয়া কফিশপে।

রাত্রে শুয়ে পড়ার পরেও ঘুম এলো না সুমনের। বিছানাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। মনে পড়ছিলো বাবা-মা র কথা। মনে পড়লো বাবা বলতেন, “তোর বিয়েটা হলে নিশ্চিন্ত হই।” তারপর মনে পড়লো মধুজার মুখটা। অদ্ভুত মেয়েটা, আজ যেন ওকে আরও সুন্দর লাগছিলো। মধুজার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে সুমনের তা সে নিজেও জানতে পারেনি। সুমনের একঘেয়ে জীবনে একটু আনন্দ আর খুশির ছোঁয়া হয়ে উঠেছে মধুজা। শুধু মাঝে মাঝে ভাবে, বিয়ে করার কথা এখনই কি ভাবা উচিৎ? আর তাহলে কি করে বলবে সেটা মধুজাকে? বাবা-মা ও নেই যে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেবে। নিজে বিয়ের প্রস্তাব দিতে হলে আগে মধুজাকে জানাতে হবে, দেখতে হবে ও রাজি কিনা। কিছু ঠিক করে উঠতে পারে না সুমন।

এভাবে দিন কাটছে, কিন্তু সুমন সাহস করে মধুজাকে জিজ্ঞেস করতেও পারে না। ফোনে প্রায়ই কথা হয়, মাঝে মাঝে কফিশপে আড্ডা, শপিং এ খুনসুটি, কখনও বা রাস্তার ধারে চায়ের ভাঁড় হাতে সুমন আর মধুজার প্রেম এগিয়েই চলল। এর মাঝে এক রবিবার সুমনের নিমন্ত্রন হল মধুজার বাড়িতে। মধুজা পরিবারের কাছে সুমনের পরিচয় দিল খুব কাছের বন্ধু হিসেবে। এখন সেটা শুধুই বন্ধুত্ব নাকি আরও কিছু তা ওরা দুজনেই জানে। মধুজার বাবা-মা কে নিয়ে ছোট্ট সংসার। সুমনের আদর যত্নে কোনও কমতি নেই। বাবা-মা যাওয়ার পর এই ব্যাপারটারই তো সে অভাব বোধ করছিল। বিকেলের দিকে মধুজাদের বাড়ির বিশাল খোলা ছাদে উঠে এলো সুমন একাই। ভাবছিল নিজের মধ্যে যে মধুজার জন্য টানটা অনুভব করে সে, এটাই কি ভালবাসা? মধুজাও কি এরকমই অনুভব করে তার জন্য! “কি ভাবছ?”, গলার আওয়াজে চমক ভাঙল সুমনের। “কই কিছু ভাবছি না তো। তা আমার ফ্ল্যাটে কবে আসবে বল।” “কবে যাই বল”, মধুজা উত্তর দিল। “যবে খুশি”, বলল সুমন। “বেশ তো একদিন অফিসের পরে তোমার ওখানে আড্ডা মারবো।”, মধুজা উৎসুক। সুমন হেসে ঘাড় নাড়ল।

মধুজার কাছ থেকে ফিরে এসে অনেকক্ষণ ভাবল সুমন। সত্যিই কি সে ভালোবাসে মধুজাকে? উত্তর পেল না। শেষে নিজেই ঠিক করলো, মধুজাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে বিয়ের ব্যাপারে। পরের দিন কফিশপে দুজনে আড্ডা মারতে মারতে মধুজা জিজ্ঞেস করলো, “বাবা-মা চলে যাওয়ার পর একা লাগে না?” সুমন গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল। মধুজা কোনও উত্তর দিল না। পরদিন অফিসে এসে মধুজা কে দেখতে পেল না সুমন। মধুজা বোধ হয় এই প্রথম কামাই করলো অফিসে। ভালো লাগছিল না কিছুই। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো সুমন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। মধুজাকে না দেখে মনটা কেমন কেমন লাগছে। হঠাতই ফোনটা বেজে উঠল তার। মধুজার ফোন।

— হ্যালো।

— তুমি অফিসে?

— অফিস থেকে এই বেরলাম, ফিরে আসব এবার, আজ আর ভালো লাগছে না। তুমি এলে না কেন?

— তোমার সাথে অনেক কথা আছে। যদি অসুবিধা না হয়, বিকেলে আসবো?

— চলে এস।

সুমন অবাক হয়ে ভাবল কি ব্যাপার হতে পারে। ভেবে পেল না। অগত্যা মধুজার জন্য অপেক্ষা করা যাক। ফিরে এসে তৈরি হতে হতেই ডোরবেল বেজে উঠল। মধুজা এসেছে। মধুজা এসেই প্রশ্ন করলো, “আমায় ভালোবাসো? বিয়ে করবে?” আচমকা প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা সুমন চুপ করে রইল। মধুজা আবার জিজ্ঞেস করলো, “বল সুমন, আজ চুপ করে থেকো না।” সুমন অবাক গলায় প্রশ্ন করলো, “তুমি সিরিয়াস?” মধুজা উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আজ এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি নিজেই বললেন, তুমি নিজেই নাকি ওনাকে বলেছ যে তুমি আমায় ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও। তিনি তোমার আইনত অভিভাবক বলে পরিচয় দিলেন। আমার বাবা-মা রাজি আছেন। আর সত্যি বলতে কি আমিও তোমায় ভালবেসে ফেলেছি। তবে আমাকে আগে কখনও এসব বল নি তো! আর যে তোমার কোনও অভিভাবক আছে এটাও জানাওনি!” হতবাক সুমন কি বলবে খুজে পেল না। এসব সে কাউকেই বলেনি, তার কোনও অভিভাবক আছে বলেও সে জানে না! মধুজা দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটোর দিকে দেখিয়ে বলল, “এই ভদ্রলোকই এসেছিলেন! এনার কথা তুমি একবারও বল নি তো আমায়।” অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল সুমন সেই ফটোর দিকে। সেখানে বিকেলের সোনালি রোদে উজ্জ্বল হয়ে আছে তার বাবার মুখ!

এরকম অন্যান্য লেখা