অৎ-ভুতুড়ে কথা
খুট করে একটা শব্দে ভেঙে গেল ঘুমটা। এমনিতেই আমার ঘুম বেশ পাতলা। পাশের খাটে অভীক দেখলাম গভীরভাবে ঘুমোচ্ছে। ঘড়িতে দেখলাম রাত তিনটে। উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে শুলাম, কিন্তু ঘুম এল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই আবার একবার শুনলাম আওয়াজটা। এবার বেশ জোরেই। অভীকেরও ঘুম ভেঙে গেছে। উঠে টর্চ নিয়ে চারিদিক দেখেও শব্দের কোনও কূলকিনারা খুঁজে পেলাম না। পরদিন সকালে বাড়িওয়ালাকে জানাতে তিনি বললেন, “বাবা, আমি তো আগেই বলেছিলাম। এখনও সময় আছে, অন্য বাসা খুঁজে নাও তোমরা।”
ঘটনাটা খুলেই বলা যাক। আমি সাত্যকি, বয়স ২১ বছর। শান্তিনিকেতনের একটি প্রাইভেট কলেজ থেকে ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা পড়া শেষ করে এখন জলপাইগুড়ি এসেছি বি টেক পড়তে। অভীক আমার কলেজ জীবনেরই বন্ধু। শান্তিনিকেতনে আমার সাথে পড়েছে, আর এখন জলপাইগুড়িতে বি টেক করতে এসেছে। প্রথমত, আমরা এসেছি কিছু দেরীতে। অনেক খুঁজে কলেজের কাছে একটা ঘর পাওয়া গেল। একটাই ঘর, সাথে অ্যাটাচড বাথ আর কিচেন। পাশেই বাড়িওয়ালা থাকেন একটা একতলা বাড়িতে। ঘর ভাড়া নেওয়ার কথা বলতেই তিনি বললেন, “দেখ তোমরা থাকতে পার কিনা” দু’জন দু’জনের দিকে তাকালাম। বিস্তারিত প্রশ্ন করে যা জানা গেল, তা হচ্ছে এই, বছর কুড়ি আগে এখানে একজন অন্তিম বর্ষের ছাত্র চাকরি না পাওয়ার হতাশায় আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে ওই ঘরে আর কেউ থাকেনি। থাকার চেষ্টা করেনি, তা নয়। কেউ থাকতে পারেনি। এসব শুনেও একরকম জোর করেই আমরা নিয়েছিলাম রুমটা। এখন তো আর বাড়িওয়ালাকে দোষারোপ করা যায় না, তিনি সাবধান করেছিলেন।
বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে এসব ভাবতে ভাবতে মাথাটা ধরে গেল। রুমের বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। অভীক বেরিয়েছিল, ফিরে আসতেই দু’জনে রান্না চাপিয়ে দিলাম। রান্না করেই অভীক বলল, “ভাই খুব মাথা গরম হয়েছে, চল বিয়ার খাই একটা করে।” আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম। হাইওয়ের ধারের কাউন্টারে আরেকজন ইয়ারমেটের সাথে দেখা। হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, “কিরে ওখানে ঠিকঠাক আছিস তো?” আমিও হেসে মাথা নাড়তে, অভীকের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, “দেখিস ভাই, যে মারা গেছিল, শুনেছি, পাক্কা মাতাল ছিল, আর খিস্তি সহ্য করতে পারত না। সাবধানে থাকিস।”
রাতে খেয়ে তখন দু’জনে বিয়ারের বোতল দু’টো খুলে বসেছি সবে। রান্নাঘরে বাসনপত্রের একটা জোর আওয়াজ শুনলাম। দু’জন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। তখনই ঘরে বেশ জোরে হাসির আওয়াজ শোনা গেল, সাথে কিছু অস্পষ্ট কথা, “আমি তো পড়তে পারিনি, তোদেরও পড়তে দেব না…” তারপর সব চুপচাপ। মিনিট খানেক বসে থেকে আবার বিয়ারের বোতলের দিকে হাত বাড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসির শব্দ, সাথে আরো কথা, “ইস তোরা বিয়ার খাচ্ছিস! অনেকদিন খাইনি, একটু দিবি?” দেখলাম, কিচেন থেকে একটা গ্লাস গড়িয়ে গড়িয়ে চলে এল আর কথা শোনা গেল, “দু’জন মিলে এই এক গ্লাস ভরতি করে দিস, তাহলেই হবে।” অভীক কথা না বাড়িয়ে বোতল থেকে হাফ গ্লাস ভর্তি করে দিল। অগত্যা আমিও তাই করলাম। মনে মনে ভাবলাম, এত মহা ফিচেল ভুত! বিরক্তও করে, বিয়ারও চেয়ে খায়! যেন সিনিয়রের র্যাগিং হচ্ছে!
সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল। সারারাত হাসির শব্দ, ভুতের জীবনের অশেষ দুঃখের কাহিনীর কাঁদুনিতে আমাদের ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে। ঘুম চোখেই কলেজ দৌড়লাম দু’জন। এসে চুপচাপ বসে আছি কাছের চা দোকানে। রেডিওতে শোনা যাচ্ছে সত্যজিৎ রায় মশায়ের বিখ্যাত গান, ‘কাউকে যদি ভুতে ধরে, মোদের যেন খবর করে…’ আচমকা অভীক বলে উঠল, “সারারাত জ্বালিয়েছে, আজ ভুতকে আমিও না দেখে ছাড়ব না। যেমন বুনো ওল, আমিও তেমন বাঘা তেঁতুল।” আমি ওর দিকে অবাক ভাবে তাকাতেই সে বলল, “মনে রাখ, ভুত মদ খেতে ভালোবাসে আর খিস্তি পছন্দ করে না।” যেমন ভাবা তেমন কাজ। দু’জনে বাইরেই রাতের খাওয়া সেরে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আমার কাছে একটা চুরুট ছিল, সেটা ধরিয়ে দু’জনে এক এক করে টানতে লাগলাম আর দু’জনে গ্লাসে করে হুইস্কি ঢেলে খাওয়া শুরু করলাম। বেশি সময় লাগল না, পাঁচ মিনিটেই ভুতের কাঁদুনি শুরু হল, সাথে হুইস্কির জন্য কাকুতি মিনতি। কিন্তু ফল হল উলটো। যতবারই ভুতের করুন স্বর শোনা যায়, ততবারই আমাদের মুখ থেকে চার অক্ষর, পাঁচ অক্ষরের বন্যা বয়। ভুত কাঁদুনি গাইতে গাইতে বিরক্ত হয়ে গেলেও আমরা কোনওভাবেই বিরক্ত হই না। অবশেষে রাত আড়াইটের দিকে ভুত রণে ভঙ্গ দিল। আমরাও ভাবলাম, যাক এযাত্রা ব্যাটাকে জব্দ করা গেছে। দু’জনে হুইস্কি শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
এরপর ভুতুদাদাকে আর চার-পাঁচ দিন দেখিনি, থুড়ি, শুনিনি। তারপর যেদিন শুনলাম, সেদিন আবার দু’জনে তেড়ে খিস্তি দিলাম কয়েক মিনিট। তাতেই তিনি বিদায় নিলেন। এরপর যতবার ই তাঁর সাথে মোলাকাত হয়েছে, আমাদের বাছাই করা কিছু চার অক্ষর আর পাঁচ অক্ষরের সম্ভাষণ শুনেই তিনি বিদায় নিয়েছেন। এভাবেই মাস কয়েক কাটলো। ইতিমধ্যে শেষ দু-এক সপ্তাহ ভুতু দাদার সাথে কোনও সাক্ষাৎ হয় নি। দু’জনে বেশ নিশ্চিন্তে আছি। বোধ হয় তিনি এ যাত্রা আমাদের পিছু ছাড়লেন। হয়ত ঘরের পিছুও ছাড়লেন।
কয়েক মাস কেটে গেছে। মহানন্দে আছি দু’জনে। একটা সেমিস্টারের পরীক্ষাও হয়ে গেছে। এরকমই একদিন রাতে খেতে বসেছি; আলু সেদ্ধ, ডাল ভাত। হঠাৎ একটা গলা শুনতে পেলাম, “তোরা ডাল ভাত দিয়ে আলু সেদ্ধ খাস?! আমার খুব প্রিয় জিনিস। এখন তো শরীরই নেই। তাই খেতে ইচ্ছে করলেও খাওয়া যায় না” বেশ দুঃখ মাখা শোনালো কন্ঠস্বর! কিন্তু এটা তো তেনার গলা নয়! আবার অন্য কোনও ভুতকে জুটিয়ে দিলো নাকি! দু’জনে এর ওর দিকে তাকালাম। বোধ হয় আমাদের মনের কথা পড়ে ফেলে তিনি উত্তর দিলেন, “আরে পাগলা, আমিই রে! ঠাণ্ডা লেগেছে! তাই ওরকম শুনতে লাগলো” ভুতের আবার ঠাণ্ডা লাগে নাকি! কে জানে বাবা! আমরা তো আর ভুত হইনি, তাই জানি না। তবুও গলা ছেড়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তা ভুতু দাদা ঠাণ্ডা লাগালেন কি করে?!” অভিমানী স্বরে উত্তর এলো, “তোরা যদি আমাকে খিস্তি দিয়ে ওরকম তাড়িয়ে দিস আমি আর কি করি! এতগুলো দিন এদিক ওদিক রাত কাটিয়ে ঠাণ্ডা লেগেছে।” ভুতেরও আবার রাগ অভিমান এসব আছে জানা ছিল না। তা সে যাই হোক, ভুতু দাদার কথা ভেবে একটু দুঃখও হচ্ছিল। ভাত, ডাল, আলু সেদ্ধ সবই দু’জনের খাওয়ার থেকে বেশিই ছিল। বললাম, “মদ খাওয়া যায়, আর খাওয়ার খাওয়া যায় না! এটা কিরকম কথা হল?” ভুত ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের জন্মের সময়, মানে মানুষের মরার পর, একটা চয়েস দেওয়া হয়। তাতে বলা হয় প্রিয় খাদ্য বা পানীয় বেছে নিতে, পরে সেটা ছাড়া আর কিছু খাওয়া যায় না! আমি তখন মদ বেছে নিয়েছিলাম!” আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। দুনিয়ায় অনেকের অনেক প্রিয় খাওয়ার আর প্রিয় পানীয় থাকতে পারে, কিন্তু মদও যে কারুর প্রিয়তম পানীয় হতে পারে, সেটা ছিল আমাদের ধারণার বাইরে।
এরপর ভুতু দাদার সাথে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে আড্ডা দিতাম। অভীক তাস খেলতে জানে না। তাই ভুতু দাদাকে পার্টনার করে মাঝে মাঝে তাস খেলতাম আমি। আমরা মদ খেলেও কখনো কখনো ভুতু দাদাকে ডেকে নিতাম। ‘ভুতু দাদা’ বলে ডাকলেই তিনি ঠিক হাজির হয়ে যান। তবে পড়াশোনার সময় ভুতু দাদা আমাদের কখনও বিরক্ত করে না।
ইতিমধ্যে সেমিস্টারের রেজাল্ট বেরোল। দু’জনের কারুর অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। মনে মনে ভাবছি সামনের সেমিস্টারে ভালো না হলে ক্যাম্পাসিং এ চাকরি পাওয়া বেশ চাপ হয়ে যাবে। দু’জনে গম্ভীর হয়ে বসে আছি, এমন সময় তাঁর গলা শোনা গেল, “কিরে! মুখের অবস্থা খারাপ কেন? কি হয়েছে?”
“না, রেজাল্টের অবস্থা ভালো না। ক্যাম্পাসিং টা ঝুলে যাবে মনে হচ্ছে।”
“অতো ভাবিস না, ভালোই হবে। পড়তে থাক।”
অতঃপর এই সেমিস্টারে আর বিশেষ পাত্তা পাওয়া যায় নি ভুতু দাদার। আমরাও ব্যস্ত ছিলাম পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। শুধু মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় ‘ভালো করে পড়’ শোনা যেত। যেদিন পরীক্ষা শেষ হল, সেদিন রাতে অনেক ডেকেও ভুতু দাদার খোঁজ পাইনি। পরের দিন কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ভোকেশনাল ট্রেনিং করার জন্য। দু’মাস পরে ফিরে কলেজ জয়েন করলাম যখন, তখন আবার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হল। যেদিন ফিরলাম জলপাইগুড়িতে, ঘরে এসে শুনতে পেলাম তাঁর গলা, “কিরে! কেমন ট্রেনিং করলি?” বললাম, “ভালোই। তা যাওয়ার আগে কত ডাকলাম কোনও সাড়া পেলাম না। কি ব্যাপার?” উত্তর এলো, “একটু বাইরে গেছিলাম রে তখন। তোদের তো ক্যাম্পাসিং শুরু হবে, ভালো করে প্রস্তুতি নে” একটা ছোট্ট করে ‘হুম্’ বললেও মনে মনে ভাবছি, যতই প্রস্তুত থাকি, এবারে ক্যাম্পাসিং পুরো শেষ। কপালে সিকি পয়সার চাকরিও জুটবে না!
কয়েকদিন পর ক্যাম্পাসিং শুরু হল। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। বলাই বাহুল্য যে আমাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে নি। যদিও প্রতিদিন ভুতু দাদা আমাদের চাকরির খোঁজখবর নেয়, আর যথেচ্ছ ভরসা প্রদান করে, কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিস্যু হয়নি। কোনও কোম্পানি আমাদের মত রদ্দিমার্কা ছাত্রদের চাকরি দিতে প্রস্তুত নয়। শেষ ভরসা একটা কোম্পানির চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পর ফলাফলের অপেক্ষা। কলেজের পড়া ততদিনে শেষ হয়ে গেছে। দু’জনেই জলপাইগুড়িকে পাকাপাকি ভাবে বিদায় দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হব। চাকরি যেহেতু জোটে নি, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যাওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে ভুতু দাদার কোনও সন্ধান পেলাম না। বারবার ডেকেও কোনও সাড়া এলো না। অবশেষে জলপাইগুড়ি ছেড়ে বাড়ির দিকে চললাম আমরা দু’জন। বুকে একরাশ ভালোলাগা, মন খারাপ, স্মৃতি সব কিছু ভিড় করে এলো। কলেজের ক্লাসরুম গুলোতে আর কোনোদিন বসা হবে না। কোনোদিন ঐ ল্যাবরেটরি গুলোতে ঢোকা হবে না। আর ভুতু দাদার সাথে দেখা হবে না, থুড়ি কথা হবে না।
বাড়িতে ঢুকতেই যে চমকটা অপেক্ষা করছিল, ভাবতে পারিনি। এসে জার্নির চোটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেলে ঘুম ভাঙতে মা এসে ধরিয়ে দিল দু’টো খাম, আমার নামে এসেছে। একটা যে কোম্পানির চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম সেই কোম্পানি থেকে এসেছে। অন্যটা কোনও পার্সোনাল চিঠি। উৎকণ্ঠা ভরা মন নিয়ে কোম্পানির চিঠি টা আগে খুললাম। পড়ে আনন্দে লাফাতে গিয়ে পা মচকে গেল। গাইতে ইচ্ছে করছিল, “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো, এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না…” কিন্তু মনে পড়ল, অঞ্জন দত্তের বেলা বোস আছে বটে, আমার তো নেই। তাই ব্যাপারটা ওখানেই সমাপ্ত করলাম। তারপর খেয়াল হল অন্য চিঠি টার কথা। খুলে দেখলাম শুধু চারটে লাইন, আর দেখে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো দাঁড়িয়ে বোকার মত অফার লেটারটার দিকে চেয়ে রইলাম।
ভাই সাত্যকি,
আমি চাকরি পাইনি, দুঃখটা তো বুঝি। তোরাও চাকরি পাবি না, তা কি হয়! তোরা চাকরি করে ভালো থাক তাতেই আমার খুশি। ভালো থাকিস, আর নেশা কম করিস।
ভুতু দাদা