বিশ্ব
তৃতীয় বার বিড়িটা নিভে যেতেই ‘ধুত্তোর্’ বলে ছুঁড়ে ফেলল বিশে। সকাল সকাল ওকে দেখে পাড়ার হুব্বা মদন বিশ্রী হেসে একটা অশ্রাব্য মন্তব্য করে চলে গেলো, সেই থেকেই মেজাজটা চটকে আছে তার। তার উপর আসার সময় পেছন পেছন ঘুরছিল রিনা। কোনও শব্দ করেনি সে। কিন্তু তবুও মাথায় আগুন লেগে গেছিল। রাগের মাথায় চার কথা শুনিয়েছে সে। “কতবার বলেছি সামনে আসতে না। সরে থাকতে পারিস না এই তাড়ায়? আছিস কেন পড়ে এখানে? দূর হ’ পোড়ামুখি! যত্তসব!” মাথা নিচু করে দরজার সামনে থেকে সরে গেছে রিনা। তার সাথে বিশের কথা কাটাকাটি হয় না বললেই চলে। আসলে, কথা হলে তবে তো কথা কাটাকাটির প্রশ্ন! তাছাড়া কথা কাটাকাটিগুলো কি সত্যিই কথা কাটাকাটি? কারণ রিনা কখনও কিছু ঘুরিয়ে বলে না, মাথা নিচু করে বিশের সব অপমান হজম করে নেয় নিঃশব্দে। একই বাড়ি, একই ঘরে দু’টো মানুষ কেউ কাউকে ঠিক করে চেনে কি আদৌ? কে জানে! কিন্তু এত ভাবলে চলে নাকি! জীবন তো থেমে থাকে না।
দোকান খুলতে আজ অনেকটা দেরী হয়ে গেলো। অযথা রিনা তার পেছন পেছন না ঘুরলে সব গুছিয়ে বেরতে এত দেরি হত না। সকালের ধরা খদ্দেররা দোকান না খোলা পেয়ে অন্য দোকানে গেলে, তাদের আর ফিরে পাবে না, একথা বিশে বিলক্ষণ বোঝে। তড়িঘড়ি চায়ের জল চাপিয়ে দিল সে। আরেকটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার কথা। অভাবের সংসারে ছোট থেকেই লুকিয়ে একা একা চলে যেত রোজগারের ধান্দায়, যেখানে অল্প বিস্তর খাটনির কাজ মেলে। যেখানে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা নেই সেখানেই হাজির হত বিশে, কম পয়সা হোক বা বেশি পয়সা, কোনও কাজে তার না নেই। বিড়ির অভ্যাসটা সেখান থেকেই, সঙ্গদোষে। বাপ-মা নাম রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ। হুঁহ্, ভারি তো বিশ্ব জয় করেছে সে! সকাল থেকে রাত চা-সিগারেট আর ডিম ভাজা, ম্যাগি ইত্যাদি টুকি-টাকি ফাস্ট ফুডের দোকানে উদয়াস্ত পরিশ্রম যদি বিশ্ব জয় করা হয়, তাহলে হয়েই যেত! সকাল হতে না হতেই দৌড়াও কাঁচামাল ধরতে, তারপর সারাদিন খাটনিতে যাহোক দু’পয়সা রোজগারের আশায় কোনও মতে সইয়ে নেওয়া। এই চেয়েছিল সে? জানেনা! বিশে ভাবতে বসল, সত্যিই এটাই জীবন? জীবনের কাছে ঠিক কি চেয়েছিল সে? কিন্তু সেসব ভাবার কি আর জো আছে!
“কই রে বিশে, একটা চা দে চটপট!”
“দিচ্ছি স্যার!”, বলে কাজে মন দেয় বিশে। এই ঝাঁ চকচকে অফিস পাড়ায় একটা ছোট্ট দোকান তার। এখানে সরকারী বাবুদের গা এলানো আলস্য নেই, আর তাই দোকানির নেই খোশগল্প করার সুযোগ বা সময়। এখানে আছে বিদেশি ধোপদুরস্থ ব্যস্ততা আর কড়া পয়সার গন্ধ। এখানে নেই খুচরো বকশিশ বা ঘন ঘন বড় নোট ভাঙানোর আবেদন, আছে শুধু হিসেবি অনলাইন পেমেন্ট; পোড়ো পুরনো বাড়ির মতো সরকারী অফিসের বদলে যেন বহুতলের কাঁচে সূর্যের প্রতিফলন জাহির করে এক অদ্ভুত দম্ভ। এখানে বাবু আর দিদিমণিদের ভিড় সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে বিদেশি কেতার স্যার আর ম্যাডামদের। এত অচেনার ভিড়ে শুধু চেনা রাস্তায়, চেনা ছকে বয়ে চলেছে কলকাতার জনসমুদ্র, অন্তহীন।
“হল রে? জলদি দে, মিটিংটা শুরু হয়ে যাবে। আর একটা কিং সাইজ সিগারেট। আমি ইউ পি আই করে দিয়েছি।”
চটজলদি চা আর সিগারেট এগিয়ে দিয়ে আবার ভাবতে থাকে বিশে। পিতৃদত্ত সম্পত্তি বলতে তার আছে শুধু একটা ভাঙা সাইকেল। ছোটবেলা থেকে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে যা জমিয়েছে, তার ফসল এই এক চিলতে দোকানটা। বাবার নিজের যা ছিল, তা চলে গেছে কালের মায়ায়। বাবা বলতেন, “সবার কথা ভাবিস রে বিশু, দেখবি নিজের জোগাড় ঠিকই হয়ে যাবে।” কোথায় কোন বুড়ো-বুড়ি খেতে পায়নি, কোথায় কার বাচ্চার ওষুধ দরকার, ভাঙা সাইকেলে বিশের বাবা সেখানে ঠিক হাজির হতেন। বিশের একদম পছন্দ হত না। কিন্তু, বাবার মুখের উপর না বলা তার হয়ে ওঠেনি। শীতের রাতে কাঁপতে থাকা ভিখারীর কম্বল হোক বা গরীব ছাত্রের দরকারী বই, সব কিছুর সমাধান হয়ে যেত বাবার কাছে। একটা একটা করে মায়ের জমানো গয়না, নিজেদের এক ফালি জমি সবই চলে গেল এভাবে। বিশের রাগ হত খুব। এ কেমন সাহায্য করা বাপু! নিজেরটুকুও রাখবে না? কিন্তু, ওই যে, বাবার উপর কথা বলার সাহস তার কোনওকালেই হয়নি। এত কিছুর পরেও কোনওদিন খাওয়া পরার অভাব হয়নি তাদের। সে জানে না বাবা কিভাবে এতকিছু সামাল দিতেন বা ঠিক কি মন্ত্রবলে তাদের বাড়িতে দরকারের সময় অভাব বোধ হতো না। বিশের ছোটবেলাতেই মা মারা গিয়েছেন, বাপ-ব্যাটার দু’জনের কষ্টের সংসারে যাহোক করে ঠিক মিটে গেছে সমস্ত দরকার। একেবারে ছোটবেলায় অবাক হত বিশে, বাবাকে জিজ্ঞেস করত যে কি জাদুতে তাদের খাওয়া জুটে যায়। বাবা হাসতেন, বলতেন, “ঠিক জুটে যায়, তুই সবার খেয়াল রাখলে, তিনি তোর খেয়ালও ঠিক রাখবেন।” বড় হয়ে আর জিজ্ঞেস করত না সে। কারণ জানা ছিল যে এর সদুত্তর সত্যিই নেই। কিন্তু তাতে হাত পাতার লোকের অভাব থাকত না, আর তার বাবাও সাহায্যের অভাব রাখতেন না।
এই টানাটানির মধ্যেও আরেকটা কাজ বাবা করেছেন। জোর করে পড়িয়েছেন সরকারী স্কুলে, খোঁজ নিয়েছেন রোজ গিয়ে মাষ্টারমশাইদের কাছে যে ছেলে ঠিক ঠাক পড়ছে কিনা। বাবার কাজকর্মে অসন্তুষ্ট হলেও বিশে উচ্চ মাধ্যমিক টুকু পাস করেছে। তারপর বেছে নিয়েছে অমানুষিক পরিশ্রম। বাবা চাইতেন, বিশে পড়াশোনায় মন দিক। কিন্তু, বিশে তো খুঁজেছিল একটু সম্বল, একটু ভবিষ্যৎ। কিরকম ভবিষ্যৎ তা সে জানে না যদিও। কিন্তু এত হাতখোলা বিশে নয়, হতেও পারবে না কখনও। সে নিজের টুকু বুঝে নিতে জানে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাই টুকিটাকি কাজ করার চেষ্টা করে গেছে। প্রথম প্রথম জোগাড়ের কাজ, তারপর দোকানে দোকানে ফাই ফরমাস খাটা, মূলত চায়ের দোকানে। অভাবের সংসারে তিল তিল করে কিছু জমিয়েছে সে, বাবার চোখের আড়ালে। আচ্ছা, বাবা জানতেন কি? না মনে হয়। বা জানলেও বলেননি কখনও। জেনে হোক, বা না জেনে, বাবা কখনও কাউকে সাহায্য করতে পিছপা হননি। নেই নেই করে যা ছিল, সব টুকরো টুকরো হয়ে চলে গেল এভাবেই। চলে গেলেন বাবাও। রয়ে গেলো শুধু ভিটে টুকু, একটা ভাঙা সাইকেল, আর রিনা।
কে জানে কোথা থেকে জোগাড় করে এনেছিলেন মেয়েটাকে বাবা। কারা ফেলে দিয়ে গেছিল বছর সতেরোর মেয়েটাকে রাস্তায়, ছেঁড়া পোশাকে সারা গায়ে হাত পায়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। সেখান থেকে প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় উদ্ধার করে আনেন বাবা। তারপর হাসপাতাল, কোর্ট-কাছারী, পুলিশ ইত্যাদি। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না দোষীদের, না বাড়ির লোকেদের! নাকি খুঁজে পেতে দেওয়া হল না, কে জানে! শারীরিক সুস্থতা এলেও মনের ক্ষত সহজে মোছে না। বছরের ঘুরে গেলো, চিকিৎসা চলতে লাগল, আর রিনা ঠাঁই পেলো বিশেদের বাড়িতে। বিশের পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। পাড়ার লোকে আড়ালে পাঁচটা বাঁকা কথা রটিয়ে বেড়ায়। বাবার সামনে বলার সাহস বোধ হয় নেই, তাই আড়ালেই গুজব বেড়ে চলে। বিন্দুমাত্র সহ্য হত না ব্যাপারটা বিশের। রিনার সাথে কখনও কথা বলেনি সে তাই। হঠাৎ অসুস্থ হলেন বাবা, বেড়েই চলল অসুখ। কেউ ধরতে পারল না কি সমস্যা, দিনের পর দিন শুকিয়ে যেতে লাগলেন। যথাসম্ভব সেবা করে চলল রিনা। তাও বিশের মনের পরিবর্তন নেই। রিনাকে সে সহ্য করতে পারে না। ও মেয়ের এ বাড়িতে থাকাই উচিৎ না। দুনিয়ার সব অঘটনের সৎকার করার দায়ভার কি এই একটা পরিবারের নাকি! আসলে কিছু মানুষকে হয়তো জগত সংসারে পাঠানোই হয় শুধু বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। নিজেকে নিয়ে সেই মানুষগুলো ভাবার সময় পায় না। শুধু দিয়েই চলে তারা, নিজের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে, না ভেবে যে তাকে কেউ মনে রাখলো কিনা। বাবার ওপর কথা বলা বিশের পক্ষে সম্ভব না। এর মাঝে বাবা জেদ ধরলেন রিনার সাথে বিশের বিয়ে দেবেন। রিনার সাথে বাবার কি কথা হয় বিশে জানে না। বাবার জেদে হয়ে গেলো বিয়ে। মন্দিরে, পুরোহিত ডেকে। কিন্তু বিশে সাফ জানিয়ে দিল, এ বিয়ে সে মানে না। রিনা বেশ কয়েকবার কাছে আসার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু বিশে যৎপরোনাস্তি অপমানের সাথে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সত্যিই তো মানার কোনও কারণ আছে কি? কোথাকার কোন মেয়ে তার নাম ধাম পরিচয় নেই, বিয়ে করে তার সাথে থাকবে এটা সে মানবে কেন?
“দু’টো কফি দাও বিশে। আর দু’টো ফ্রায়েড ম্যাগি ডিম দিয়ে।”, বলেই ভদ্রলোক মগ্ন হয়ে গেলেন সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে জমে থাকা মেয়েটির সাথে। খুব চেনা লাগে মেয়েটাকে, কোথাও যেন দেখেছে, কিন্তু মনে পড়ছে না। ম্যাগি বানাতে মন দেয় বিশে। মনে পড়ে বাবা থাকতে বাবা বেশ রান্না করতেন। বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বিশেই রান্না করেছে। হ্যাঁ, তিন জনেরই করেছে, বাবার মুখ চেয়ে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও। আর নিজেই করেছে রান্না, কারণ ওই মেয়ের হাতের রান্না সে খাবে না কখনও। কোনওদিন খুঁজেও দেখেনি মেয়েটা কি খায়, কি পরে। আচ্ছা, বাবা বিয়ে দিলেন কেন? বাবা তো জানেন, মেয়েটাকে প্রথম থেকেই পছন্দ নয় বিশের। যদিও রিনা মাথা নিচু করে চুপচাপই থেকেছে সবসময়, কোনওভাবেও বিশের মন গলেনি। বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বাবা মারা গেলেন। আত্মীয় স্বজন কোনওকালেই কেউ ছিল না সেভাবে। যারা ছিল, তারা জানত কপর্দক শূন্য এক পরিবারের কাছে পাওয়ার আশা তো কিছুই নেই, বরং হঠাৎ হাত পেতে বসলে উলটে কিছু দিতে হলে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আর তার উপর একটা নাম-গোত্র হীনা মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তার মুখোমুখি হওয়ার বাসনা বোধ হয় কারুর রইল না। না এলো পাড়া পড়শি, না এলো বন্ধু-বান্ধব। একা একাই শেষকৃত্য সম্পন্ন করল বিশে। হ্যাঁ, রিনা ছিল বটে, কিন্তু সে তো ধরার বাইরে! এত ঝামেলা সবই তো মেয়েটার দোষে। আজ মদন যে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচে হাসি দিয়ে বলে গেলো, “বেশ্যার বিশে”, সেটা যে রিনার কারণেই তা বিশে খুব ভালোই জানে। খুব ভালো করেই বোঝে পাড়ার লোকের বা বন্ধুবান্ধবের কটু মন্তব্যের পেছনে এই ছন্নছাড়া মেয়েটা ছাড়া আর কিছুই কারণ নেই। আসলে সমাজ বড় অদ্ভুত। লড়াই করে টিকতে না পারলে এখানে স্থান পাওয়া যায় না। বাবা চলে গেছেন সপ্তাহ খানেক আগেই। আর সহ্য হয় না, এবার দূর করেই দেবে রিনাকে, তাড়িয়ে না দিলে থাকা যায় না আর, থাকতে দেয় না এ সমাজ।
“এই নিন স্যার কফি, আর ফ্রায়েড ম্যাগি ডিম দিয়ে…” প্লেট দু’টো এগিয়ে দিতে দিতে বিশে চিনতে পারল মেয়েটাকে। এই সামনের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটায় পড়ত। মাস তিনে’ক আগেও এসেছে মেয়েটা তার দোকানে। না, একা নয়, প্রেমিকের সাথে, যাকে আজকের যুগে বলে বয়ফ্রেন্ড। সম্ভবত সহপাঠীই ছিল কেউ ছেলেটা। অনেকবার এসেছে তারা, একই কলেজ ইউনিফর্মে, হাতে হাত ধরে, মাস তিনেক আগেও। একে অপরকে খাইয়ে দিয়েছে হাতে তুলে। মিষ্টি প্রেম দেখতে ভালোই লাগত বিশের। মনটা ফুরফুরে হয়ে যেত। আচ্ছা, সে কি এরকম একটা মধুর প্রেম চেয়েছিল? নাহ্, জানে না বিশে, জীবন তাকে সেসব ভাবার সময় দেয়নি। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটা তার করা হয়ে ওঠেনি, সেটা পড়ে আছে ভবিষ্যতের জিম্মায়।
“নাহ্, আমার বয়ফ্রেন্ড-টেন্ড নেই। ওই একজন ক্যাজুয়াল ছিল, সেরকম সিরিয়াস নয়। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার ভরসা নেই, ক্যাম্পাসিং এ একটা চাকরি জোটাতে পারল না…”, মেয়েটার টুকরো কথা ভেসে এলো বিশের কানে। সত্যি বড় অদ্ভুত এই দুনিয়া। এত দীর্ঘ একটা সম্পর্ক, তার ভীত এতটা আলগা। মানুষ তার জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করেই চলেছে সবসময়। এই হিসেবটাই সব, এটাই চালিয়ে নিয়ে যায়। এই জমা-খরচের অংকটা আর কিছুই না, স্রেফ আবেগ মোহ মায়া সব কিছুকে হারিয়ে ডারউইনকে নিঃশর্তে জিতিয়ে দেয়, বারবার। যেমন সে হেরে গেছে এই সমাজের কাছে, হাস্যাস্পদ হয়ে গেছে সমাজের চোখে। কিন্তু ঠিক কোন আবেগটা মারা পড়ল তার? বিশে ঠিক জানে না।
“অনলাইন করে দিলাম।”, বলে দু’জনে বেরিয়ে গেলো দোকান থেকে। দৃষ্টিপট থেকে মিলিয়ে যাওয়া দু’টো অবয়বের দিকে তাকিয়ে বিশে ভাবতে থাকল আবার। এই যে সম্পর্ক গুলোকে কি সমাজ সত্যিই ধরে রাখে নাকি স্রেফ একটা অপরিণত মুকুলকে ঝরিয়ে দিতে চায় প্রবল ঝড়ে। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, আস্থা কি এতই ঠুনকো? তার নিজের বিশ্বাসের জোরই বা কতদূর? কই, বাবা তো কখনও কারুর ওপর বিশ্বাস হারান নি, সহস্রবার ঠকেও এই সমাজকে সাহায্য করার অপ্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। কোনও জমা-খরচের হিসেব করেননি, কখনও চাওয়া-পাওয়া মেলাতেও যাননি। নির্দ্বিধায় শুধু দিয়ে গেছেন, সর্বস্ব উজাড় করে। সমাজ তাঁকে হয়ত মনে রাখেনি, কিন্তু বাবা তো সেকথা ভাবেননি। তাহলে বাবা ঠিক কি চেয়েছিলেন জীবনে? বিশে নিজেই বা কি চায়? ঠিক কোন জিনিসটা সে চেয়েছিল, যা পায়নি? তার বেঁচে থাকার মত অন্ন-সংস্থান ছাড়া মাথা ব্যথা ছিল না কিছু নিয়েই। চরম দারিদ্রেও সেটুকু তার জুটে গেছে সবসময়। রিনাকে সে চায়নি, হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই জমার অংকটাকে খরচের খাতায় বিশে মেলাবে কি করে? দূর করে দিলেই খরচের অংকটা মিলবে তো? আচ্ছা, অংকটা মেলানোর দায়িত্বটা কি সমাজ তাকে লিখে দিয়েছে? বাবা তো এতজনের এত অংক মিলিয়ে দিলেন? তাঁর হিসেবটা খতিয়ে দেখল কি কেউ? বা, তাতে বিরাট কিছু পরিবর্তন হল কি? ভেবে পায় না বিশে।
আজ খদ্দেরও নেই বিশেষ। বিমর্ষ মনে হঠাৎ তার একবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করল। সময়ের আগেই দোকানপাট গুছিয়ে উঠে পড়ল বিশে। পুরো বাড়ি অন্ধকার, কোনও জনমানব নেই। কোথাও আলোটুকুও জ্বলছে না। ঘরে ঢুকে রিনাকে খুঁজে পেল ঘরের এক কোণে। চোখের কোণে কালি নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা বসে বসেই। রিনার নিষ্পাপ মুখটা বড় সুন্দর লাগছে আজ। আগেও হয়ত লাগত, কিন্তু বিশে খেয়াল করেনি। বা, খেয়াল করতে চায়নি। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে রান্নাঘরে অল্প চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি চাপিয়ে দিল সে, সাথে ভেজে ফেলল অল্প পাঁপড়। থালা নিয়ে এসে গিয়ে বসল রিনার পাশে। এতদিন সে খোঁজটুকুও নেয় নি, মেয়েটা কি খেলো, কি পরল, মরল নাকি বাঁচল। আজ সেই খবরটা হঠাৎ কেন কে জানে নিতে বড় ইচ্ছে করল। সদ্য ঘুম ভেঙে যাওয়া রিনার চোখে বিস্ময়ের শেষ নেই। রিনাকে ততোধিক অবাক করে নিজে হাতে তুলে খাইয়ে দিল সে। রিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বিশে হঠাৎ বলে উঠল, “রিনা নয়, আজ থেকে তুই আমার রাণী।” চকিতে অনুভব করল, সত্যিই বিশ্ব জয় করেছে সে আজ। ওই যে, তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে চোখ মুছছে তার বিশ্ব।