Thumbnail image

স্বপ্ন নাকি সত্যি

একটি সুকুমার রায় অনুপ্রাণিত বাংলা সাহিত্য মাল্টিভার্স ফ্যান ফিকশন

উফ্‌! কি গরম পড়েছে। ল্যাবে কেউ নেই, এখনও আসেনি। হাঁফাতে হাঁফাতে ল্যাবের এয়ার কন্ডিশনারটার দিকে তাকালাম। প্রশান্ত দা সম্ভবত মরুভূমির পাব্লিক, ২৮ এর নিচে নামলেই হুকুম আসে টেম্পারেচার বাড়ানোর। কিন্তু এই শীতে এত গরম লাগছে কেন? না, জানি কলকাতার আবহাওয়ার কোনও মা বাপ নেই, কিন্তু এত গরম লাগাটা তো অস্বাভাবিক। ল্যাবের সব থেকে জুনিয়র মেম্বার অক্ষয়। হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন, অবাঙালী অক্‌শয় নয়, পুরোদস্তুর বাঙালী, অক্ষয়। তার চিরাচরিত স্বভাব, ও সর্বকনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে দায়িত্বও বটে, ল্যাবের সমস্ত বোতলে জল ভরে রাখার। সেই আশায় উঠে অক্ষয়ের ডেস্কে গিয়ে দেখলাম পাঁচটা বোতল কানায় কানায় ভরে রাখা আছে। সেখান থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে এসে নিজের ডেস্কে বসলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। আমাদের ল্যাবের কম্পিউটারগুলো খোলাই থাকে, কী করে কে জানে আমার ডেস্কটপটা বন্ধ হয়ে গেছে। পাওয়ার বাটনটায় আলতো চাপ দিয়ে গলা ভেজানোয় মনোনিবেশ করলাম। কিন্তু এ কি! এটাতো জল না! স্বাদটা বড় অদ্ভুত, কিন্তু অতি পরিচিত। আমি বুঝতে পারছি এ বস্তু কি, কারণ এ আমার অতি প্রিয় জিনিস। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, এখানে জলের বোতলে এ জিনিস কিকরে এলো? আর কেনই বা এলো?! পাশ থেকে রাজেশের গলার আওয়াজ এল, “আরে প্ল্যান করতে করতে কোথায় হারিয়ে গেলে?” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই রাজেশ প্রশ্নটা করেছে। এরা কখন এলো ল্যাবে, দেখতে পাইনি তো! সাথে কুশলও আছে, প্রশ্ন করল, “তাহলে আমরা কত কিলো খাসী আনবো? আর আসল জিনিস কে তুলতে যাবে?” অ্যাঁ? এ আবার কিরকম প্রশ্ন! কিসের পরিকল্পনা চলছিল এখানে? আর আসল জিনিসটা কি আমি যা ভাবছি তাইই, নাকি অন্য কিছু সেটাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। এই ভেবে প্রশ্নটা সবে করতে যাবো, এমন সময় স্যারের গলা কানে এলো, “এই তোমরা যা প্ল্যান করবে কর, আমার কিন্তু মিটিং আছে। খাসী কাটলে আমার ঘরের বাইরে কাটবে। ল্যাবে খাসী কাটলে পরিষ্কার করে দেবে ভালো করে।” আমার হাঁ বন্ধ তো হলই না, আরও বড় হয়ে গেলো! এসব আবার কি! ল্যাবে খাসী কাটবো? কেন? আর স্যার এখানে কী করছেন? আমরা যদি সত্যিই ‘আসল জিনিস’, মানে কারণসুধার প্ল্যান করে থাকি, তাহলে সেখানে স্যারকে কে ডাকলো?! পাগল নাকি লোকজন! ব্যাপারটা হজম হতে হতে টের পেলাম আমরা স্যারের রুমে বসে আছি। ল্যাবটা কখন স্যারের ঘর হয়ে গেলো! যাহ্‌ বাবা!

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “এই তোরা চল তো! স্যারের মিটিং আছে, ল্যাবে গিয়ে বাকি প্ল্যান হবে।” স্যারও মাথা নাড়লেন। স্যারের ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে মাথায় এলো, আমি তো অনেকদিন এই ল্যাবে কাজ করি না। আমি কার ডেস্কটপ অন করছিলাম?! আচ্ছা, সে ল্যাবে গিয়ে দেখা যাবে নাহয়। কিন্তু ল্যাবে ঢুকেই তাজ্জব বনে গেলাম। না কোনও ডেস্ক, না কোনও মেশিন, রাখা আছে সারি সারি বেঞ্চ; ঝকঝকে নতুন হোয়াইট বোর্ড হয়ে গিয়েছে ধুসর কালো ব্ল্যাকবোর্ড, লিখে লিখে বেশ কিছুটা অপরিস্কার। তার ওপরে আলতো করে রাখা দু’টো চক। একটা বেঁটে মত লোক খুব কষ্ট করে দেওয়ালে ডাস্টার ঝেড়েই চলেছে। আমরা এতকিছু গুরুত্ব না দিয়ে সোজা গিয়ে বসে পড়লাম মাঝের দিকের দু’টো বেঞ্চ দখল করে। প্রথম প্রশ্ন করার আগেই দেখলাম বেশকিছু ছেলে এসে চারদিকে বসে যাচ্ছে বেঞ্চে। ক্লাসরুমটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ভরে গেলো। সবার গায়েই স্কুলড্রেস। আমি আবার খেই হারিয়ে ফেলেছি। বুঝতে পারছি না, ইউনিভার্সিটিতে স্যারের নিজস্ব রিসার্চ ল্যাবটা হঠাৎ স্কুলের ক্লাসরুম হয়ে গেলো কিভাবে! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম ক্লাস নিতে ঢুকে পড়লেন অনুপম দা, সাথে একটা গীটার! আমরা হই হই করে উঠলাম, “আরে দাদা আপনি এখানে? কী ব্যাপার?!” দাদা একটু কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাদের কাছে রুমাল হবে ভাই? জাহাজ তাড়াতে যেতে হবে!” সবারই পকেট থেকে ভাঁজ করা রুমাল বেরিয়ে এলো। দাদা খুশি হয়ে বললেন, “শাবাস্‌! অনেক জাহাজ তাড়ানো যাবে আজ! এমনি বন্দরে এলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমার কাছে কিছুই নেই দেওয়ার মত, সব ওবেলার ডালভাতে ফুরিয়ে গেছে।” কেউ একটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু আমাদের ক্লাসের কী হবে?” দাদা দিব্যি হিপপকেট থেকে একটা লম্বা দূরবীন বের করে বললেন, “এই নাও, আমার যা ছিল, এতেই আছে, চোখ দিলেই দেখা যাবে। আমার নাহয় এতে চোখ রাখা মানা, তোমাদের তো নয়। আমি চলি, টাটা!” হাত ঘুরতে ঘুরতে দূরবীনটা আমার কাছে আসতেই অনেক কৌতুহল নিয়ে চোখ দিলাম। ও মা! দেখি, পরমব্রত মুচকি হাসছেন আর বলছেন, “কাল থেকে ক্লাস আমি নেব।” এতকিছু হই হট্টগোলের মাঝেও খেয়াল করলাম রাজেশ তখনও আমার কাছেই বসে আছে। তাকে বললাম, “তোর বাইকটা বের কর। এসব উদ্ভট কান্ড দেখে আমার মাথা চটকে গেছে। ধোঁয়া চাই, তার জন্য আগুন দরকার, আগুন!”

রাজেশ উঠে গেলো বাইক বের করতে। আমিও উঠে এগোতে যাবো, দেখি একটা ছেলে সামনের সিট বেঞ্চে বসে হাই বেঞ্চে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। ছেলে না তো, লোক। ভালো করে কাছে গিয়ে দেখতে যেতেই আমি আঁতকে উঠলাম। বাবা! বাবার পেছনের বেঞ্চে বসে আমি আগুন খুঁজছিলাম? কেলো করেছে! আমার বাবা এই স্কুলেরই শিক্ষক, কিন্তু তাই বলে বেঞ্চে এসে ঘুমোবে সে কল্পনা কস্মিনকালেও করিনি। কাছে যেতেই বাবা দেখলাম চোখ খুলেছে। আমাকে বলল, “আগুন? হুঁহ্‌! ওসব আগুনের ভয় আমাকে দেখিও না, ছোট থেকেই আগুন নিয়ে খেলি! আমার ছেলে আমাকেই কিনা আগুন শেখাবে! ছোঃ! তোদের বয়সে বুকে আগুন নিয়ে পড়েছি, পেটে আগুন নিয়ে লাঙল করেছি। সেই আমার ছেলে হয়ে তোর কাছে আগুন নেই! ছিঃ! মেলা গোল করিস না, আমাকে ঘুমোতে দে।” বলেই আবার ঘুমিয়ে গেলো। যাক, এযাত্রা বাঁচা গেলো বলে যেই এগিয়েছি, যে বেঁটে লোকটা এতক্ষণ ডাস্টার ঝাড়ছিল, সে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো। চোখে মোটা চশমা, গায়ে আধময়লা একটা হাফ শার্ট, কোমরে একটা ঢোলা পুরনো ফর্মাল প্যান্ট দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। একহাতে একটা পুরনো রুলটানা খাতা, তাতে ভর্তি ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে কিসব লেখা ছক কেটে কেটে; আরেক হাতে পেন্সিল। আবছা চিনতে পারলাম, ইনি বোদে দা, আমাদের স্কুলে সাইকেল গ্যারাজের রক্ষক ছিলেন। ক্লাসে ক্লাসে হানা দিয়ে সাইকেল গ্যারাজের বকেয়া টাকা আদায় করতেন। কিন্তু আমি তো এখন স্কুলে পড়ি না। এসেই একগাল ফোকলা হেসে তিনি বলে বসলেন, “এই তোর সাইকেলের টাকা বাকি আছে।” আহ্‌, কি মুশকিল! এখানে সাইকেল আসবে কোথা থেকে! কিন্তু সেকথা বলতেই বোদে দা হাঁই হাঁই করে তেড়ে এলেন, “এই তো বাইক নিয়ে এলি যে!”

“অহ্‌! তারও ভাড়া! তা কত বাকি আছে?”

“দাঁড়া, হিসেব করি…”

বেশ খানিকক্ষণ দাঁতে পেন্সিল চিবিয়ে হাতের কর গুনে হিসেব করে বোদে দা বললেন, “তোর হয়েছে ৫১ টাকা তিন আনা সাড়ে তেতাল্লিশ পয়সা, আর একটা বোতল।”

“বোতল?”

“হ্যাঁ, স্কুলে পড়ে এইসব খাস লজ্জা করে না? বোতল বাজেয়াপ্ত করা হবে!”

যাচ্চলে! এখানে বোতল কোথা থেকে এলো আবার! আমি তো স্কুল জীবনে ‘নেশা’ বলে শব্দটার অস্তিত্ব জানতাম না। সেই আমাকেই কিনা এরকম অপবাদ! তীব্র প্রতিবাদ জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো, “ও তুই খাসনি? তাহলেই ভালো। আসলে বেশ কিছু ছেলে নেশা করে স্কুলে ঢুকেছে, বোতল বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে!” আমি বলে উঠলাম, “বাবা এসেছেন…”

“আচ্ছা! তুই বোতল বাদ দিয়ে সোজা বাবার কাছে চলে গেছিস! তোর সাহস তো কম নয়!”

“আরে ধুর্‌! সে বাবা নয়! আমার বাবা এসেছেন, ওখানে বেঞ্চে বসে আছেন।”

“ভোলেবাবা সবার বাবা! তোর বাবা কে?”

“আরে বোদে দা, আপনি চিনতে পারেননি এখনও? আমার বাবা, মানে ডি. এম. স্যার এসেছেন, ওইদিকে বেঞ্চে বসে আছেন।”

“ওহ্‌, স্যার এসে গেছেন? তাহলে চিন্তা নেই। স্যার সব ম্যানেজ দিয়ে দেবেন। ঠিক আছে, তোর তাহলে ছুটি আজকের মত।”

এই বলেই বোদে দা হাঁক পাড়লেন, “সুকান্ত… ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দাও…” অমনি দূরে কোথাও ঢং ঢং করে ঘন্টা বেজে উঠলো। সব ছেলে একসাথে ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। আর তার মাঝেই বোদে দা শ্যেন দৃষ্টিতে খুঁজে খুঁজে পাকড়াও করছেন, “এই তোর ৩ মাসের টাকা বাকি, আর তোর ৭ মাসের…” সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এমন সময় এই হই হট্টগোলের ওপরে গলা চড়িয়ে কে যেন “ছুটি, ছুটি…” বলে দৌড়ে আসছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম আলখাল্লা পরা সন্তোষ দত্ত আসছেন, মাথায় সেই পাগড়ি। না, মানে তিনি আসছেন না, তাঁকে নিয়ে আসা হচ্ছে, বাইকে। রাজেশের বুলেট! কিন্তু বাইক তো রাজেশ চালাচ্ছে না, সামনে আরেক সন্তোষ দত্ত বসে! মাথায় পাগড়ি, সাদা জোব্বা। বোদে দা তেড়ে গিয়ে পথ আটকালেন, “এই তোমাদের টাকা বাকি আছে, পয়সা না দিয়ে কোথায় যাবে?” ঠিক তখনই বাইকটা ব্রেক কষে দাঁড়ালো, কিন্তু ব্রেকের আওয়াজ বেরলো ‘চিঁহিঁহিহি…’ বোদেদা আবার শুরু করলেন, “তুই পয়সা না দিয়ে পালাচ্ছিস! তোর ঘোড়া স্কুলের বাগান খেয়ে ফেলেছে! এর বিচার হবে। কঠিন শাস্তি হবে, কোনও মাফি হবে না। এই যাচ্ছি, হেডস্যারকে ডেকে আনবো।” ওদিকে সন্তোষ দত্ত বলছেন, “পয়সা কি কম পড়িয়াছে?”

আমি এখনও ঠাহর করতে পারছি না যে ঠিক কী চলছে। কিরকম সব কিছু ঘেঁটে যাচ্ছে। একটু মাথাটা ছাড়ানো দরকার ভেবে যেই সামনে তাকালাম দেখি দু’টো ছেলে, নাকি লোক, বুঝতে পারলাম না, তাদের বেঁটে খাটো চেহারা, রোগা হাত পা, কমবয়সী ছোকরার মত, কিন্তু তার সাথে একমুখ প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া গোঁফ-দাড়ি। বেশ কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বল্‌, ইঞ্জিনিয়ারিং এর বাংলা কী? বল্‌!” আমি বেশ একটা কেউকেটা ভাব করে বললাম, “তাতে তোমাদের কী হে!” তারা চোখ পাকিয়ে মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, “ফর্মাল পরে আবার মুখে মুখে তর্ক! সিনিয়রদের মানছিস না যে বড়!” আমি এবার সত্যিই অবাক। পেছন থেকে বিশু দা বলে উঠল, “তোমাদের যেমন বুদ্ধি! ও দাদা তোমাদেরও সিনিয়র, কাকে ধরেছ ফার্স্ট ইয়ার ভেবে?” এই শুনে ছেলেগুলো ততধিক রেগে গেলো, “বললেই হবে! নিশ্চয়ই ফার্স্ট ইয়ার! নাহলে ফর্মাল পরেছে কেন? তার উপর আবার বেল্ট ও পরেছে। আর আমাদের থেকে নিশ্চয়ই ছোটো, আমাদের বয়সের ভারে দাড়ি পেকে গেলো, আর এ কিনা আমাদের সিনিয়র! হুঁহ্‌!” কিন্তু আমি সেদিকে নেই, আমি তখনও ভেবে চলেছি, যে এই আজব জায়গাটা ঠিক কোথায়। আর এখানে বিশু দা এলো কোথা থেকে। এই ভেবে যেই বিশু দার দিকে তাকিয়েছি, সে ফ্যাক করে একগাল হেসে দিলো। চারদিকে চেয়ে দেখলাম, আমি হাইওয়ের ধারে বিশু দার চা দোকানে দাঁড়িয়ে, কলেজ মোড়ে। একটু দুরেই আমাদের কলেজ দেখা যাচ্ছে। আর আমাকে ঘিরে বেশ কিছু পুঁচকে ছোঁড়া আমার ইন্ট্রো নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু আমি তো কলেজ পাশ করে বেরিয়ে গেছি অনেকদিন হয়ে গেলো। এরা কি সত্যিই চিনতে পারে না ফার্স্ট ইয়ারদের? নির্বিকার মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা কোন ইয়ার?” উলটে তারা আমাকে প্রশ্ন করে বসল, “আমরা যেই ইয়ার হই না কেন তুই এখানে কেনো? কী ব্যাপার?” ঠিক তো! আমি এখানে কেন? হ্যাঁ, আমার কলেজে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল বটে কিছু বিশেষ কাজে, কিন্তু আমি কি সত্যিই এসেছিলাম? তাহলে আমার কাছে কাগজপত্র কোথায় যেগুলো সই করানোর দরকার ছিল! আর, সত্যিই যদি না এসে থাকি তাহলে আমি এই কলেজ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি কী করে!

কি যে ছাই হচ্ছে আগাপাশতলা কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। আমার মনের কথাটা পড়ে নিয়েই কোনও এক ভদ্রলোক পেছন থেকে বলে উঠলেন, “ভাবো, ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।” পেছন ঘুরে দেখি এক রোগা সিড়িঙ্গে ভদ্রলোক, গায়ে আধময়লা পাঞ্জাবি পাজামা আর কালো কোট, মাথায় উস্কো-খুসকো কাঁচাপাকা চুল, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে কিছু বললেন?” ভদ্রলোক যেন আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন, “তোমরা ভাবলে কাজ হয়! তোমরা ভাবো, আমি আপাতত বোতলটা শেষ করি।” এই বলেই ভদ্রলোক আমাকে একটা গ্লাস ধরিয়ে বোতলটা নিজের ঝোলায় পুরে ফেললেন। আমি বুঝলাম যে আমার চিন্তাশক্তি শেষের পথে। এরপর যা হবে তার বিশ্লেষণ করতে শান্ত করতে হবে নিজেকে। এমনিও চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। অতএব, কোনওদিকে না তাকিয়ে গ্লাসের পানীয় এক ঢোকে গলাধঃকরণ করলাম। স্বাদ বুঝলাম না, সে ক্ষমতা আমার ততক্ষণে লোপ পেয়েছে। তারপরই স্থিরভাবে ধ্যানে বসে পড়লাম। কিন্তু ছাই জানিও না ধ্যানে কী করে বা কাকে ডাকে, কস্মিনকালে ওসব করিও নি। উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসতে লাগলো। হঠাৎ কে যেন ডাকলো, “গুড় খাবে? গুড়?” ধ্যানের মধ্যে কাউকে দেখতে পেলাম না। জোর করে চোখ চেপে আছি, খুলবো না! কিন্তু আবার সেই একই প্রশ্ন, গলাটা আমাদের ল্যাবের সিনিয়র কিঙ্কর দার। চোখ খুলেই যেন ধড়ে প্রাণ এলো। আমি যেই ল্যাবে বসে ছিলাম, সেখানেই আছি। সামনে শুধু কিঙ্কর দা দাঁড়িয়ে। কিন্তু কিছু একটা মিলছে না, কী সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। কিঙ্কর দার দিকে তাকাতেই সে কাকে একটা ইঙ্গিত করে বলল, “ওকে এক বোতল গুড় দিয়ে যা!” বলার সঙ্গে সঙ্গেই একজন বিদেশি প্রৌঢ় ভদ্রলোক উপস্থিত হলেন। লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান, মাথায় হাল্কা সোনালী চুল, দিব্যি স্যুট প্যান্ট পরে আছেন। হাতে একটা শ্যাম্পেনের বোতল, সেটা আমার দিকে নিঃশব্দে বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। শ্যাম্পেনের বোতলে গুড়! এ আবার কেমন জাতের ব্যবস্থা রে বাবা! সন্দিগ্ধ মনে জিজ্ঞেস করলাম, “গুড় শ্যাম্পেনের বোতলে? এটা গুড় তো? নাকি শ্যাম্পেন? নাকি তাড়ি?” ভদ্রলোক জিভ কেটে পরিস্কার বাংলায় বলে উঠলেন, “আমার গুড় নিয়ে আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই। সারা বাংলা আমার গুড়কে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে।” এই গুড়ের গূঢ় তত্ত্ব কী জানা নেই, চেখে দেখলাম, চমৎকার! অবাক হয়ে বললাম, “গুড়ই আপনার ব্যবসা?” শুনেই ভদ্রলোক হেসে ফেললেন, “শীতকালে তাইই, তবে সারাবছর আমি ছবি বানাই, সিনেমা নিয়ে আমার কারবার।”

“অ্যাঁ? সিনেমা? আপনি গুড় আর সিনেমা দুইই বানান?”

“যে আজ্ঞে।”

“আপনাকে তো কালটিভেট করতে হচ্ছে মশায়! কী নাম আপনার?”

“নলেন বলতে পারেন, নোলান ও বলতে পারেন, টাইমমেশিন ও বলতে পারেন।”

যাহ্‌ শালা! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চারদিকে তাকাতেই গোলমালটা মাথায় ঢুকলো। ল্যাবটা ঠিক ল্যাব নয়, ল্যাবের অবিকল মিরর ইমেজ। ল্যাবের দেওয়ালটা কাঁচের। সেখানে আমার অবাক হয়ে যাওয়া প্রতিবিম্বটা অট্টহাস্য শুরু করছে, দিয়ে বলে উঠল, “বটে! এত বুদ্ধি তোমার ঘটে!” ল্যাব যদি মিরর ইমেজ হয়, তাহলে আমি কি আসলেই আমি? নাকি, আয়নায় আমার মতো যে দাঁড়িয়ে সেইটা আসল আমি, আর এই আমিটাই ভুয়ো! আমতা আমতা করছি দেখে সেই প্রতিচ্ছবি আমিই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো, “খটকা রে তোপসে, একটা খটকা! আমরা কি সত্যিই ল্যাবে?” আমার রীতিমত পাগল হওয়ার যোগাড়। চোখ বন্ধ করে ভাবতে শুরু করলাম শুরু থেকে শেষ সবটাই, যদি কোনও কূল কিনারা পাওয়া যায়। নাহ্‌, কিচ্ছু নেই, সব ব্ল্যাঙ্ক, ফাঁকা, একদম আর্যভট্ট! চোখ খুলে তাকাতেই দেখলাম আমি একটা লম্বা করিডরে দাঁড়িয়ে আছি। ভুল হল, দু’টো লম্বা করিডরে দাঁড়িয়ে আছি। ঠিক যেন একটা চার মাথার মোড়। আর আমার ডাইনে-বাঁয়ে আগে-পিছে সব মিলিয়ে চারটে দরজা, নীল রঙের। সে নীল বড় অদ্ভুত, ঠিক আকাশেরও না, আবার সমুদ্রেরও না। কিন্তু আমি এখন ঠিক কী করবো? কোন দরজার দিকে এগোবো? নাকি এখানেই মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবো? বুঝছি না!

বেশ কিছুক্ষণ ভেবে স্থির করলাম, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই কিছু। কোনও একটা দিকে এগিয়ে যেতে হবে, কিন্তু কোন দিকে?! ঠিক করে উঠতে পারছি না। অনেকক্ষণ ভেবে সামনের দিকে যে দরজা পেলাম সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতেই একটা চারদিক ঘেরা উঠোন, মাঝে একটা কুয়ো। সেদিকে এগোতেই কুয়োর ভেতর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, “তুমি কে? তোমার নাম কি ফিওদোর অরলিনোভস্কি?” জোরে চেঁচিয়ে না বলায়, আবার প্রশ্ন এলো, “তাহলে কি তুমি ওয়াংচু দ্রিঘাংচু?” আমি আবার চেঁচিয়ে বললাম, “না, আমি কেউ না, একদম কেউই নই। কিন্তু তুমি কে হে? কুয়োর মধ্যে কী করছ?” উত্তর এলো, “আমি হিজিবিজবিজের ভাই, আমার নামও হিজিবিজবিজ। গতকাল আমার নাম ছিলো তকাই, আগামীকাল আমার নাম হবে তাতিন!” বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম, “ওসব রাখো, এটা কোন জায়গা বলতে পারো?” খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর জবাব এলো, “সদর দরজা দিয়েই তো এলে! আমি এখানে চিকিৎসা করি, বাকি তুমি যেরকম চাইবে সেরকম হবে।”

অ্যাঁ! মানে? খানিকক্ষণ ভেবে বুঝলাম, সদর আর চিকিৎসা মানে এটা সদর হাসপাতাল। অর্থাৎ আমি উত্তরবঙ্গে। আমাকে যেতে হবে কলেজ মোড়, সেটা করতে পারলে কিছু ঠাহর হবে ঠিক পথে আছি কিনা। কিন্তু যতই চেষ্টা করি বেরনোর কোনও দরজা খুঁজে পাই না। একমাত্র দরজা দিয়ে আমি এসেছিলাম। অগত্যা উপায় না পেয়ে সেই দরজা দিয়ে আবার চারমুখ ওয়ালা করিডরে ফিরে এলাম। এবার রওনা দিলাম উলটোদিকের দরজায়। এটা খুলতেই দেখলাম পুরোদস্তুর হাসপাতাল। ব্যস্ত হয়ে লোকজন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে, ডাক্তার, নার্স সবাই। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বুঝলাম এটাও উত্তরবঙ্গ, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল। এখান থেকে কলেজ মোড় সামান্যই দূর। অতএব বাইরে বেরনোর রাস্তা খুঁজতে শুরু করলাম। কিন্তু এতক্ষণে লোকজন যেন আমাকে খেয়াল করলো। দু’টো ষণ্ডামার্কা লোক আমার পিছু নিয়েছে। পা চালালাম, সাথে তারাও গতি বাড়ালো। এখন আমি রীতিমত দৌড়াচ্ছি, পেছনে ধাওয়া করছে সেই লোক দু’টো। সবার কথাবার্তার টুকরো অংশ কানে আসছে দৌড়াতে দৌড়াতে। সেসব শুনে আরও তাজ্জব বনে গেলাম। তার অর্থ এই যে, আমি মানসিক ভারসাম্যহীন, সাইকায়াট্রি ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। এই মেরেছে! এই জন্যেই কি লোক দু’টো দৌড়াচ্ছে আমার পেছনে? বেশিক্ষণ লাগলো না, ধরা পড়ে গেলাম। হাত, পা, মুখ চেপে তারা আমাকে সেই নীল দরজা দিয়ে বার করে দিল পাগলখানার সেলে। আমার এই মুহুর্তে প্রচন্ড খিস্তি দিতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য পাগলে কী না বলে! অতএব, আমি যাইই বলি না কেন, তা এই ষণ্ডা লোক দু’টো পাগলের প্রলাপ হিসেবেই গ্রহণ করবে। কিন্তু কোন পাগলাগারদের সেল এরকম চারমাথার মোড় হয়?! যত্ত সব!

নাহ্‌, আমাকে অন্য রাস্তায় এগোতে হবে। কিন্তু কোনদিকে আগে যাবো? ডানদিকে না বামদিকে? আমি মধ্যমপন্থী, আমার পক্ষে স্থির করা বড়ই কঠিন। মাথার ওপর কে যেন বলে উঠলো, “সঠিক প্রশ্ন করো, সঠিক উত্তর দাও। তবেই বদল আসবে! দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।” খুব সুচতুর কথা। কিন্তু দিক যখন জবাবেই পেতে হবে, সেই উত্তর হিসেব করে বাঁদিকে এগিয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতেই দেখি, আবার সেই স্কুলের ক্লাসরুম, এখন একদম ফাঁকা। কিন্তু ঢোকা বা বেরনোর একটাই দরজা, সেটা দিয়েই আমি এসেছি। আমার স্কুল থেকে আমার বাড়ির দুরত্ব হাঁটা পথে পাঁচ মিনিটের। অতএব বেরতে পারলেই আমি সোজা বাড়ি পৌঁছে যাবো। দেখি জানলাগুলো ভেঙে বেরনো যায় কিনা। কিন্তু জানলাগুলো তো জানলা নয়। সেগুলো ছবি, দেওয়ালে আঁকা। এ কেমন ক্লাসরুম!একটা বেঞ্চে বসে মিনিট দু’য়েক জিরিয়ে নিলাম। আর একটাই দরজা বাকি। যা থাকে কপালে। এই ভেবে দৌড়ে সেই দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাঁফিয়ে গেছি ইতিমধ্যে। আস্তে আস্তে দরজা খুলতেই দেখলাম আমি আবার সেই উলটে যাওয়া ল্যাবে। শুধু নোলান দা দাঁড়িয়ে আছেন সামনে, আর কেউ কোথাও নেই। তিনি মুচকি হেসে পকেট থেকে একটা ছোটো লাট্টু বের করে দিলেন আমাকে, “সত্যি-মিথ্যে, জীবিত-মৃত সব কিছুর ফয়সালা করবে এই লাট্টু। নিয়ে যাও, কাজে দেবে। কিন্তু এখানে নয়, চারমাথার মোড়ে।” লাট্টু হাতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এ লাট্টু যদি থামে, তবে আমি সুস্থ আর যা দেখছি সেসব আজব কিসসা আমার মনের ভুল। আর যদি না থামে, তাহলে ভীষণ বিপদ। সোজা সেই করিডরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালাম। লাট্টুটা দেখলাম হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দিতেই ঘুরে গেলো। কিন্তু এ কি! এ লাট্টু তো মাটিতে পড়লো না! হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সোজা ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। এর ওপর কি মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না! ঘাড় তুলে উপরের দিকে তাকাতেই দেখলাম সেখানে আরেক আমি। আরও একটা ছবি, কিছুটা ছায়া মার্কা। সেই আমিও হাত থেকে একটা লাট্টু ছেড়েছে, যেটা তার ওপরের দিকে, মানে মেঝের দিকে নেমে আসছে। দু’টো লাট্টু একসাথে ছুঁয়ে যেতেই জোরে বাজ পড়ার মত একটা আওয়াজ হলো।

সাথে সাথে আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো। আমি অক্ষয়ের রুমে ঘুমোচ্ছিলাম, পাশের খাটে সে ব্যাটাও ঘুমোচ্ছে। পাশে খাসীর মাংসের প্লেটটা এখনও আছে, আর দু’টো বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে; সাথে অক্ষয়ের ডেস্কের সেই জলের বোতলটাও, যদিও জানি না তাতে জলই ছিল কিনা। একটা ফ্যাঁস ফেঁসে আওয়াজ পেয়ে খোলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথা থেকে একটা টকটকে লাল বিড়াল চশমা পরে বসে থাবা চাটছে আর বিশ্রী হাসছে। তেড়ে যেতেই তেতলার বারান্দা দিয়ে কোথায় যেন পালালো। কিন্তু সেখানে পড়ে রইল একটা সাদা রুমাল, যেটা অনুপম দাকে দিয়েছিলাম। তুলে দেখলাম, তাতে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লেখা, “তুই কি ব্যাকরণ শিং না ছোটমাসি?!”

Related Posts