মই
আনমনেই হাঁটছিলাম রাস্তা দিয়ে। পাড়ার গলি রাস্তা, তাই গাড়ির সংখ্যা কম। ঘন্টা তিনেক হল কারেন্ট নেই। শীতে পাখার দরকার নেই, তাই গরমে ঘুম হবে না, এরকম সমস্যাও নেই। কিন্তু বিকেলের মুখে বিদ্যুৎ না থাকা বেশ সমস্যাকর। আলোর অভাবে অনেক কাজই বন্ধ পড়ে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার মোড়ে এসে পৌঁছলাম যেখানে ট্রান্সফর্মার লাগানো আছে। বিকেলের আবছা আলোয় চোখে এল দু’জন লোক মই নিয়ে ট্রান্সফর্মারে উঠে কাজ করছে। মইয়ের ওপরে যে রয়েছে, তাঁর চেহারা বাঁটুল দি গ্রেটের থেকে কোনও অংশে কম না। পার্থক্য একটাই, বুকটা পেটে আর পেটটা বুকে!
মনেমনে মইটার দশা কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। ওইটুকু একটা মই, তায় ওজনই বা কতটুকু, তার ঘাড়ে এরকম দশমনি বস্তা চাপানোটা রীতিমত অত্যাচার। নাহয় সে কথা বলতে পারে না, নাহয় তার মুখ নেই, নাহয় সে জড়বস্তু, তাবোলে কি সে মানুষ নয়! না মানে, তার কি প্রাণ নেই, থুড়ি ছিল না! পাঠক হয়ত ভাবছেন, মইয়ের আবার প্রাণ! কিন্তু ভুলে যাবেন না, একদা সে শক্ত-সমর্থ বাঁশ ছিল। আচ্ছা বাঁশ তো লোকে দেয়, মানে কারুর বিরাট সর্বনাশ করাই বাঁশ দেওয়া। আবার শুনেছি পাকা ধানে মই দেওয়া মানে তো সুসম্পন্ন কাজ পন্ড করা। মানে মইও দেওয়া যায়! মই বাঁশ থেকে তৈরি হয়, অর্থাৎ বলা যায় মই বাঁশের থেকে কিছুটা উন্নত মানের দ্রব্য। তিতুমির যদি বাঁশের কেল্লার বদলে মইয়ের কেল্লা বানাতেন, তাহলে বোধ হয় ইংরেজ শাসনের সেখানেই ইতি হয়ে যেত!
এসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, “দাদা, মইটার বয়স কত?” লোকটা অবাক ভাবে তাকিয়ে মাথা চুলকে জবাব দিল, “তা অনেক হবে, আমার মনে নাই, কেন কয়েন তো?!” উত্তর দিলাম, “না মানে ভাবছিলাম, কতদিন ধরে অত্যাচার সহ্য করছে।” সেটা শুনে লোকটা বেশ খুশি মনে বলল, “তা আর কইতে দাদা! কত আপদ-বিপদ বাঁচাইছে এ মই!” উৎসুক চোখে তাকালাম। লোকটা বলেই চলল, “একবার ইখানকার মেইন টেরান্সফর্মারে ফিউজ উইড়া গিছিল। তখন আমি সবে ১৩ বছর। ইলেকটিরির কাজ শিখতেছি সবে। আমার গুরু বিশাল নামী ইলেটিরিসিয়ান, রঘুরাম পাঠক। তাঁর তিনটা বাড়ি আছে আলাদা আলাদা জায়গায়, আর সব বাড়িতেই ইলেটিরির কাজের যন্ত্রপাতি মজুত আছে। আপনাদের ওই কলকেতা শহরেও বড় রকম গোলযোগ হইলে ওঁর ডাক পড়ত। তা সেদিন হইছে কি, গুরুর প্রচন্ড জ্বর। তা তিনি আমারে ডাইকে পাটালেন। আমারে কইলেন, ‘তুই হামার সবসে আচ্ছা ইস্টুডেন্ট, তুই গিয়ে দেখ। যদি কিছু কোরতে পারিস’ অথচ আমি হাউস ওয়্যারিংও ঠিকমত জানি না তখন। তবু কইলুম, ‘কত্তা আমার তো মই নাই।’ তিনি সবাইকে মইতে উঠতে দিতেন না। কইতেন মই নাকি মানুষের ছোঁয়া বুঝে। তিনি কইলেন, ‘হামার মইটা নিয়ে যা। আজ ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে ওটা তোকে দিব’ সেই থেকে এ মই আছে আমার কাছে। কত কিরিটিকাল কন্ডিশনে ঠিকঠাক কাজ কইরতে পেরেছি এই মইয়ের সুবাদে। আমি মনে করি এ আমার ওই কি কয় না, ভাগ্য দেওতা না কি, তাই। একবার বাড়িতে চোর ঢুইকেছিল। আমি টের পেয়ে এই মই বার কইরে তেড়ে গেছিলুম। চোর পলাইতে রাস্তা পায় নাই।”
একসাথে এত কথা বলে লোকটি হাঁপিয়ে গেছে। রুমাল বের করে মুখ মুছল। এদিকে মই বাবাজী বোধ হয় এত প্রশংসা সহ্য করতে পারেননি। তিনি কান্নাভেজা গলায় বললেন, “ক্যাঁচ!” বলে বোধ হয় চোখ মুছতে গিয়ে একটু নড়লেন। তাতেই টাল সামলাতে না পেরে ওপর থেকে লোকটি পড়ে গিয়ে ‘উই মা’ বলে বিকট চিৎকার করে উঠল। আমার সাথে কথা বলা লোকটি চেঁচিয়ে উঠল, “ক্যা রে ছোটুয়া, কোই কাম নেহি হোতা তুঝসে!” বলে তাকে তুলে ধরে দাঁড় করাল। তারপর নিজেই উঠতে শুরু করল। কিন্তু মইও ছাড়বার পাত্র নন। তিনিও ‘ক্যাঁচ-ম্যাচ’ শব্দে কান্না শুরু করলেন। আমি বললাম, “দাদা এত সাধের মই যখন, তাহলে এরকম দশমনি বস্তাকে তুলেছেন বা কেন ওতে? বেচারা মৃতপ্রায়!” ছোটুয়া নামের ছেলেটি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু ব্যাপারটা বেশিক্ষণ টিকলো না, মই বাবাজী হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়লেন। সাথে তাঁর পেয়ারের মালিককেও ফেললেন। আমি বললাম, “আপনার এত আদরের মই, ভেঙে গিয়ে এখন বাঁশে পরিণত হয়েছে, দেখুন এই বাঁশটাও কাউকে দিয়ে যেতে পারেন কিনা।” ততক্ষণে আশেপাশে লোকজন জড় হয়ে গেছে। দেখলাম মইয়ের মালিক আর তার চ্যালা কেউই আমার পিছু করার অবস্থায় নেই। এই দেখে চুপচাপ সময় ও বাক্য ব্যয় না করে পিঠটান দিলাম।